তানভীর আহমেদ::
*বেড়েছে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য
* মারধরের শিকার হচ্ছেন কর্মীরা
* সার্বক্ষণিক পুলিশ অথবা আনসার মোতায়েনের দাবি।
সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত এক মাসে বহিরাগতদের কয়েক দফা হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছেন হাসপাতালের কর্মীরা। হাসপাতালের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলেও বিভিন্ন সময়ে ‘রাজনৈতিক প্রভাবে আপস-দফারফা’ করায় দালালচক্র ও বহিরাগতরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের। দালাল, বহিরাগতদের উপদ্রবে হাসপাতালে সেবার স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, হাসপাতালের অভ্যন্তরে রোগীদের নিরাপদে চিকিৎসা গ্রহণ, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা প্রদানের সুযোগ করে দিতে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন অথবা আনসার মোতায়েন দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
জানা যায়, সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর দালালদের হামলার তিনটি বড় ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় একটি দালালচক্রণ জরুরি বিভাগের ডাক্তারদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ মারধরের হুমকিও দিয়ে আসছে প্রায়ই। এরমধ্যে, গত রোববার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে সিনিয়র স্টাফ নার্স (ব্রাদার) জাহাঙ্গীর আলমকে বহিরাগত সাব্বির আহমেদ নামে এক যুবক মারধর করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে হাসপাতালের কর্মরত নার্স ও ব্রাদাররা ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন। পরে, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশ অভিযুক্ত সাব্বির আহমেদকে গ্রেফতার করে। সাব্বির আহমেদ সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের মৃত আবেদ আলীর ছেলে। এর আগে গত ১৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের নিচতলায় সিরিয়াল ভেঙে এক্স-রে করতে না দেওয়ায় একই এলাকার বাসিন্দা আপ্তাব উদ্দিনের ছেলে ফরহাদ (৩৩) ও শিমুল (২৮) এক্স-রে রুমে প্রবেশ করে এক ওয়ার্ডবয়কে বেধড়ক মারধর করেন। মারধরের শিকার ওয়ার্ডবয় পিয়াল হোসেন বাদী হয়ে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও পরে তা আপস করা হয়েছে। গত অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সদর উপজেলার হালুয়ারগাঁও গ্রামের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জাবেদ আহমেদ টেটা দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে সাপে কামড় দিলে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন পরিবারের লোকজন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালেই মারা যায় জাবেদ। এরপর জাবেদের পরিবারের লোকজন চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে উত্তেজিত হয়ে চিকিৎসকদের উপর চড়াও হন। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন চিকিৎসকদের। এসময় হাসপাতালে থাকা অন্যান্য লোকজন তাদের বুঝিয়ে শান্ত করেন। এদিকে, ২০২১ সালের ১৩ জুলাই জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে চিকিৎসক আবু জাহিদ মোহাম্মদ মাহমুদকে মারধর করার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরই মামলার মিজানুর রহমান (২০) নামের একজনকে আটক করে পুলিশ। তিনি শহরের হাসননগর (সুলতানপুর) এলাকার আকিল মিয়ার ছেলে। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, হাসপাতালের জরুরি বিভাগকে বহিরাগতরা মনে করেন এটি যেন তাদের আড্ডাখানা। তাদের অভিযোগ, দালালচক্র জরুরি বিভাগকে ব্যবহার করে অসহায় রোগীদের ভুল চিকিৎসার ফাঁদে ফেলছে। একইসাথে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালরা। দালালদের এই অপতৎপরতার প্রতিবাদ করতে গেলেই চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর হামলা হচ্ছে। তারা আরও বলেন, হাসপাতালে ওতপেতে থাকা দালালরা কোনো জটিল বা গুরুতর অসুস্থ রোগী জরুরি বিভাগে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাদের প্রাথমিক পরীক্ষার পর অবস্থার অবনতি বা উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বুঝে দ্রুত সিলেটে রেফার করলে দালালচক্র এই রেফার করার সুযোগটিকেই কাজে লাগায়। তারা রোগীর স্বজনদের বোঝাতে শুরু করে, এত দূরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কম খরচে এবং দ্রুত এই হাসপাতালেই উন্নত চিকিৎসা করিয়ে দিতে পারবে। চিকিৎসকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে, দালালরা রোগীদের সুচিকিৎসা বঞ্চিত করে। এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। এর বিনিময়ে তারা রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। দালালদের এই ফাঁদে পড়ে ভুল চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। চিকিৎসক ও নার্সরা যখন এই অবৈধ কর্মকা- ও অপচিকিৎসার প্রতিবাদ করেন, তখনই তারা দালালদের রোষানলে পড়েন। সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স (ব্রাদার) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত রোববার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে আমি একজন রোগীর ড্রেসিং করছিলাম, এমন সময় সাব্বির আহমদ নামে এক যুবক বাইরে থেকে আরেকজন রোগী নিয়ে এসে টেবিল খালি করতে বলে। আমি কাজ করছি জানালে সে ক্ষুব্ধ হয়ে গালিগালাজ শুরু করে। প্রতিবাদ করায় সে আমাকে মারধর করে। আমার সহকর্মীরা এসে আমাকে উদ্ধার করেন। আমরা কি এখানে চিকিৎসা সেবা দিতে এসেছি নাকি মার খেতে? এভাবে চলতে থাকলে রোগীদের সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নার্স বলেন, শুধুমাত্র জরুরি বিভাগে নয়, গাইনি ওয়ার্ডেও দালালদের উৎপাত রয়েছে। এদের বেশিরভাগ হাসপাতালের আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। এদের কোনো কিছু বললেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার পাশাপাশি হুমকি দেয়। ভয়ে অনেক সময় আমরা প্রতিবাদ করি না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় এই হাসপাতালে কেউ কাজ করতে আসতে চাইবে না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. চিন্ময় বলেন, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর একের পর এক হামলা হচ্ছে। দালাল চক্রটি স্থানীয় হওয়ায় তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। হাসপাতাল থেকে দালাল নির্মূলের জন্য সবাই মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। তবে, কোনোভাবেই নির্মূল করা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, দালালরা রোগীদের নিয়ে টানা হেঁচড়া করে। নানাভাবে রোগীদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। আমরা যখন কোনো রোগীকে পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দিই তখন দালালরা রোগীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যায়। এভাবে রোগীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে দিনদিন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। ডা. চিন্ময় বলেন, প্রতিনিয়ত দালাল চক্রের সদস্যরা ডাক্তার ও নার্সদের গালিগালাজ করছে। সবাই ভয়ে মুখ বুজে সহ্য করছেন। কিন্তু এইভাবে তো আর চলা যায় না। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই বা প্রতিবাদ করলেই হামলা হয়। আমরা বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। হাসপাতালের কনসালটেন্ট (অবস্ এন্ড গাইনী) ডা. লিপিকা দাস বলেন, একের পর এক হামলার ঘটনায় সবাই আতঙ্কে আছে। এমনিতেই এখানে ডাক্তার ও নার্সরা আসতে চায় না। আসলেও এক - দুই বছরের বেশি থাকতে চায় না। তারপর যদি এভাবে হামলা হয় তাহলে তো এখানে ভালো ডাক্তার আসতে চাইবে না। এতে তো নিজেদেরই ক্ষতি হবে। তিনি আরও বলেন, অফিস টাইমের পর দালালরা গাইনি ওয়ার্ড থেকে শুরু করে সকল ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক টহল দিতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে হাসপাতালের রোগীদের ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সহকর্মীদের উপর বারবার হামলা হওয়ায় বাকিদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হামলা বা মারধরের সাথে যারা জড়িত তাদের বেশিরভাগই স্থানীয় হওয়ায় এই দালালচক্রটি খুবই শক্তিশালী। আমরা আশা করব, প্রশাসন দ্রুত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ ক্যাম্প অথবা আনসার মোতায়েন করার দাবিতে আমরা সংশ্লিষ্টদের কাছে শীঘ্রই চিঠি লিখবো। পুলিশ বা আনসার সদস্য সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকলে দালাল চক্র ভয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করবে না। সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন কারণে এমনিতেই সুনামগঞ্জ জেলায় ভালো ডাক্তাররা আসতে চান না বা এলেও বেশিদিন থাকতে চান না। তার ওপর যদি এমন লাগাতার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এই জেলায় কোনো ভালো ডাক্তারকে আনা বা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ডাক্তার না থাকলে স্বাস্থ্যসেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর একটি স্থানে এই ধরনের হামলা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্প অথবা আনসার মোতায়েন করা প্রয়োজন। তাহলে নির্বিঘ্নে সেবা দিতে পারবেন হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) রাকিবুল হাসান রাসেল বলেন, জরুরি বিভাগে প্রবেশ করে নার্সকে হামলার ঘটনার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একইসাথে মামলার বাকি আসামিদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত আছে। শীঘ্রই তাদেরকেও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। জড়িতদের কেউ কোনোভাবেই ছাড় পাবে না। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের টহল কার্যক্রম বাড়ানো হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
- আপলোড সময় : ২৬-১১-২০২৫ ১১:১৪:০৯ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৬-১১-২০২৫ ১১:১৬:২১ পূর্বাহ্ন
ছবি: সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সুনামকণ্ঠ